সোনা কেনা প্রতিটি বাঙালির কাছেই আবেগ এবং বিনিয়োগের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিয়েবাড়ি হোক বা উৎসবের উপলক্ষ, অথবা নিছকই ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় — সোনার প্রতি আমাদের টান চিরন্তন। তবে বর্তমান বাজারের অস্থিরতায়, বিশেষ করে ২০২৫ সালে সোনার আকাশছোঁয়া দামের কারণে ক্রেতাদের মনে জন্ম নেয় নানা প্রশ্ন ও সংশয়।
একজন বিশেষজ্ঞ এসইও লেখক এবং স্বর্ণবাজার বিশ্লেষক হিসেবে, এই প্রবন্ধে আমরা গ্রাহকদের মনে সোনা কেনার আগে জেগে ওঠা সবচেয়ে সাধারণ ১৫টি প্রশ্নের গভীর ও তথ্যবহুল উত্তর দেব। এখানে থাকবে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান, বিশেষজ্ঞ মতামত এবং আপনাকে একজন সচেতন ক্রেতা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সব টিপস।
চলুন, শুরু করা যাক সোনার ঝলমলে দুনিয়ায় আপনার নিরাপদ যাত্রার গাইডলাইন।
সোনা কেনার আগে গ্রাহকদের মনে থাকা প্রধান ১৫টি প্রশ্ন
সোনা কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই প্রশ্নগুলো ভালোভাবে জেনে নিন।
১. ২০২৫ সালে বাংলাদেশে সোনার দাম এত বেশি কেন?
বাংলাদেশে সোনার দামের ঊর্ধ্বগতিতে অনেক ক্রেতাই অবাক হচ্ছেন। অক্টোবর ২০২৫-এ ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রতি ভরি ২,১৩,০০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়, যা একটি রেকর্ড। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক ও স্থানীয় কারণ রয়েছে:
- বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা: ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় (safe haven) হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকছেন, যা বিশ্ববাজারে চাহিদা ও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
- মার্কিন ডলারের শক্তিশালী অবস্থান ও টাকার অবমূল্যায়ন: সোনা আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারে লেনদেন হয়। ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন বা দরপতনের ফলে দেশে সোনা আমদানির খরচ অনেক বেড়েছে, যা স্থানীয় বাজারে দাম বাড়াতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনা কেনা: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেমন চীন, ভারত, পোল্যান্ড, তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৈচিত্র্যময় করতে বিপুল পরিমাণ সোনা কিনছে। এটিও বিশ্ববাজারে সোনার চাহিদা বাড়িয়েছে।
- সরবরাহ ও চাহিদার ব্যবধান: বাংলাদেশে বার্ষিক ২০-৪০ টন সোনার চাহিদা থাকলেও, এর ৮০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক বা চোরাই পথে পূরণ হয়। বৈধ আমদানিতে জটিলতা ও শুল্কের কারণে এই ঘাটতি তৈরি হয়, যা বাজারে দামকে প্রভাবিত করে।
বাজার বিশ্লেষক ড. সাইমা হক বিদিশার মতে, “মানুষের পুঁজিবাজারে আস্থা কম থাকায় সাধারণ মানুষ সোনা বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।”
২. বিভিন্ন ক্যারেটের সোনা বলতে কী বোঝায় এবং আমার কোনটি কেনা উচিত?
সোনার বিশুদ্ধতা ক্যারেট দিয়ে মাপা হয়। ২৪ ক্যারেট হলো সবচেয়ে বিশুদ্ধ সোনা (৯৯.৯% খাঁটি)। তবে গহনা তৈরির জন্য ২৪ ক্যারেট সোনা খুব নরম, তাই এতে খাদ বা অন্য ধাতু মেশানো হয়।
বাংলাদেশে প্রধানত চার ধরনের ক্যারেটে সোনা বিক্রি হয়:
- ২২ ক্যারেট (91.6% বিশুদ্ধ): গহনা তৈরির জন্য আদর্শ। এতে ৯১.৬% খাঁটি সোনা থাকে এবং বাকিটা তামা, দস্তা বা নিকেলের মতো ধাতু মেশানো হয় মজবুত করার জন্য। হলমার্কিং কোড হিসেবে ‘916’ লেখা থাকে।
- ২১ ক্যারেট (87.5% বিশুদ্ধ): ২২ ক্যারেটের চেয়ে সামান্য কম বিশুদ্ধ।
- ১৮ ক্যারেট (75% বিশুদ্ধ): এতে ৭৫% খাঁটি সোনা থাকে। হীরা বা পাথরের গহনার জন্য এটি বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি বেশ মজবুত। হলমার্কিং কোড ‘750’।
- সনাতন বা ট্রেডিশনাল সোনা: পুরনো দিনের গহনা বা কম বিশুদ্ধ সোনা, যার নির্দিষ্ট কোনো ক্যারেট মান নেই। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (BAJUS) ২০২৩ সালের গাইডলাইনে সনাতন সোনা বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে এবং শুধু ১৮, ২১, ২২ ও ২৪ ক্যারেট সোনা অনুমোদিত করেছে।
পরামর্শ: যদি গহনা হিসেবে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের জন্য কেনেন, তবে ২২ ক্যারেট সোনা সেরা। বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে কিনলে ২৪ ক্যারেট সোনার বার বা কয়েন কেনাই ভালো।
৩. “ভরি”, “আনা”, “রতি” কী? সোনার ওজন কীভাবে মাপা হয়?
বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে সোনার ওজন মাপার ঐতিহ্যবাহী একক হলো ভরি, আনা, রতি। এটি জানা জরুরি:
- ১ ভরি = ১১.৬৬৪ গ্রাম
- ১ ভরি = ১৬ আনা
- ১ আনা = ৬ রতি
- ১ রতি = ৩.১৬৮ গ্রেন (Grains)
আন্তর্জাতিকভাবে সোনা গ্রাম (Gram) বা ট্রয় আউন্স (Troy Ounce)-এ মাপা হয়। ১ ট্রয় আউন্স প্রায় ৩১.১০৩ গ্রামের সমান।
৪. হলমার্কিং কী এবং সোনা কেনার সময় এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হলমার্ক হলো সোনার বিশুদ্ধতার একটি সরকারি স্বীকৃতি বা গ্যারান্টি। এটি নিশ্চিত করে যে আপনি যে ক্যারেটের সোনা কিনছেন, তাতে ঠিক সেই পরিমাণ খাঁটি সোনা আছে। বাংলাদেশে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) অনুমোদিত বা BAJUS সার্টিফায়েড হলমার্কিং সেন্টার থেকে গহনা পরীক্ষা করা হয়।
হলমার্ক করা সোনার গহনায় লেজার খোদাই করা কিছু চিহ্ন থাকে, যার মধ্যে ক্যারেট মান (যেমন: 22K916) অন্যতম।
কেন জরুরি:
- আসল সোনার নিশ্চয়তা: হলমার্ক প্রতারণা থেকে বাঁচায়।
- সহজ পুনঃবিক্রয়: হলমার্ক করা সোনা যেকোনো দোকানে সহজে ও ভালো দামে বিক্রি করা যায়, কারণ এর বিশুদ্ধতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না।
৫. সোনা আসল নাকি নকল, তা বাসায় কীভাবে পরীক্ষা করা যায়?
যদিও পেশাদার টেস্টিং (যেমন XRF অ্যানালাইসিস) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়, ঘরে বসে কিছু সাধারণ পরীক্ষা করতে পারেন:
- হলমার্ক চিহ্ন দেখা: গহনার ভেতরের দিকে বা ক্ল্যাপে (clasp) 22K, 916 বা 18K-এর মতো স্পষ্ট চিহ্ন খুঁজুন।
- ম্যাগনেট বা চুম্বক পরীক্ষা: সোনা চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। যদি আপনার গহনা চুম্বকে লেগে যায়, তবে তাতে লোহার মতো অন্য ধাতুর মিশ্রণ আছে এবং এটি খাঁটি নয়।
- ফ্লোট টেস্ট (ভাসমান পরীক্ষা): এক গ্লাস পানিতে সোনার গহনাটি ফেলুন। আসল সোনা খুব ঘন হওয়ায় সাথে সাথে ডুবে যাবে। যদি এটি ভাসে বা পানির উপর কাছাকাছি থাকে, তবে সম্ভবত এটি আসল সোনা নয়।
- রঙ পরিবর্তন পরীক্ষা: খাঁটি সোনায় কখনোই মরিচা পড়ে না বা বিবর্ণ হয় না। যদি আপনার ত্বক সবুজ বা কালো হয়ে যায় গহনা পরার কারণে, তবে এটি নিম্নমানের খাদ বা গোল্ড প্লেটেড হতে পারে।
৬. সোনার গহনার “মজুরি” বা বানানোর খরচ কত টাকা এবং কীভাবে কমানো যায়?
মজুরি (making charge or labour charge) হলো গহনা তৈরির খরচ। এটি সোনার মূল দামের অতিরিক্ত। মজুরির পরিমাণ গহনার ডিজাইন ও ফিনিশিংয়ের ওপর নির্ভর করে।
- সাধারণ হার: বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (BAJUS) ন্যূনতম ৬% মজুরি নির্ধারণ করেছে, তবে ডিজাইনের ধরনের ওপর ভিত্তি করে এটি অনেক বাড়তে পারে।
- ভিন্নতা: মেশিনে তৈরি চেইন বা আংটির মজুরি কম হয়, কিন্তু হাতে গড়া নকশি বেনারসি চুড়ি বা জটিল ডিজাইনের গহনার মজুরি ২০% থেকে ৩০% পর্যন্ত হতে পারে।
- কমানোর উপায়: মজুরি নিয়ে দরদাম করুন। অনেক জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ অফার বা ডিসকাউন্ট দেয়। এছাড়া, কম জটিল ডিজাইন বেছে নিলে মজুরি কমে যায়।
৭. সোনার গহনা বিক্রির সময় বা বদলানোর সময় মূল্য কীভাবে হিসাব করা হয়?
পুনঃবিক্রয় মূল্য (resale value) জানাটা বিনিয়োগের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ:
- বদলানোর ক্ষেত্রে (Exchange): সাধারণত গহনা বদলানোর সময় নতুন গহনার দাম থেকে পুরনো গহনার ওজনের ১০% বাদ দিয়ে মূল্য সমন্বয় করা হয়।
- নগদ বিক্রির ক্ষেত্রে (Selling for cash): যখন সরাসরি পুরনো সোনা বিক্রি করতে যাবেন, তখন জুয়েলারি দোকানগুলো বাজারমূল্য থেকে সাধারণত ২০% পর্যন্ত কেটে রাখে। এই হার দোকানভেদে ভিন্ন হতে পারে।
- পাথরের গহনা: পাথরের গহনা কিনলে বিক্রির সময় পাথরের দাম বাদ দেওয়া হয় বা খুব সামান্য মূল্য ধরা হয়। তাই বিনিয়োগের জন্য পাথরবিহীন বা প্লেইন সোনা কেনাই ভালো।
৮. সোনা কেনা কি ২০২৫ সালে একটি ভালো বিনিয়োগ?
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, চলমান বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সোনা এখনও একটি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ।
সুবিধা (Pros):
- মুদ্রাস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়ন থেকে সুরক্ষা: যখন পণ্যের দাম বাড়ে (মুদ্রাস্ফীতি) বা টাকার মান কমে যায়, তখন সোনার মূল্য সাধারণত বাড়ে, যা আপনার ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
- পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যকরণ: সোনা স্টক বা রিয়েল এস্টেটের মতো অন্যান্য বিনিয়োগের সাথে বিপরীতভাবে চলে, যা আপনার সামগ্রিক বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর ঝুঁকি কমায়।
- দীর্ঘমেয়াদী নির্ভরযোগ্যতা: ঐতিহাসিকভাবে সোনা দীর্ঘমেয়াদে মূল্য ধরে রেখেছে এবং বেড়েছে।
অসুবিধা (Cons):
- তাত্ক্ষণিক তারল্য সংকট: বড় পরিমাণে সোনা দ্রুত বিক্রি করতে গেলে স্থানীয় বাজারে কিছুটা তারল্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
- অতিরিক্ত খরচ: মজুরি, ভ্যাট (৫% সরকারি ভ্যাট) এবং স্টোরেজ খরচ আপনার নিট রিটার্ন বা লাভ কিছুটা কমিয়ে দেয়।
অধ্যাপক সাইমা হক বিদিশা মনে করেন, এই মুহূর্তে সোনা কেনা সাধারণ মানুষের জন্য একটি ঝুঁকিমুক্ত সঞ্চয়ের উপায়।
৯. আমি কি ফিজিক্যাল বা অলংকার হিসেবে সোনা কিনব নাকি ডিজিটাল উপায়ে বিনিয়োগ করব?
এটি আপনার উদ্দেশ্যর ওপর নির্ভর করে:
- ফিজিক্যাল গোল্ড (অলংকার/কয়েন/বার): ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালিরা গহনা কিনতেই পছন্দ করে (সাংস্কৃতিক ও বিনিয়োগ উভয় কারণে)। তবে অলংকার কিনলে মজুরি খরচ বেশি হয় এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে (বাসায় রাখা বা ব্যাংকে লকারে রাখা)। বিনিয়োগের জন্য কিনলে সোনার বার বা কয়েন কেনা ভালো, কারণ এতে মজুরি কম লাগে।
- ডিজিটাল গোল্ড: বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও সোনা কেনা সম্ভব। ‘Gold Kinen’ (গোল্ড কেনেন)-এর মতো অ্যাপ ব্যবহার করে ৫০০ টাকা দিয়েও ২৪ ক্যারেট সোনা কেনা যায় এবং তা বীমাকৃত ভল্টে সংরক্ষণ করা হয়। আপনি চাইলে পরে এই সোনা কয়েন বা বার হিসেবে সংগ্রহ করতে পারেন বা নগদ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। এটি মজুরি ও নিরাপত্তার ঝুঁকি কমায়।
১০. সোনা কেনার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দোকান বা জায়গা কোনটি?
সবসময় বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (BAJUS)-এর সদস্য এমন বিশ্বস্ত এবং স্বনামধন্য জুয়েলারি দোকান থেকে সোনা কেনা উচিত। যেমন: আমিন জুয়েলার্স, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, কুঞ্জ জুয়েলার্স ইত্যাদি।
অপরিচিত বা ছোট দোকান থেকে সোনা না কেনাই ভালো, যদি না তারা হলমার্ক সার্টিফিকেট এবং গ্যারান্টি প্রদান করে।
১১. সোনা কেনার সময় কী কী কাগজপত্র বা সার্টিফিকেট নিতে হবে?
এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি। সোনা কেনার সময় অবশ্যই নিচের কাগজগুলো সংগ্রহ করুন:
- পাকা চালান বা ক্যাশ মেমো: এতে আপনার নাম, ঠিকানা, কেনার তারিখ, সোনার ক্যারেট (যেমন ২২ ক্যারেট), ওজন (ভরি/আনা/রতি বা গ্রাম), প্রতি গ্রামের দাম, মোট দাম, মজুরি ও ভ্যাটের পরিমাণ স্পষ্টভাবে লেখা থাকতে হবে।
- বিশুদ্ধতার সার্টিফিকেট (Purity Certificate): হলমার্ক করা সোনার জন্য এই সার্টিফিকেট জরুরি। এতে হলমার্কিং সেন্টারের বিবরণ এবং সোনার বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা থাকবে।
- লাইফটাইম ওয়ারেন্টি কার্ড: অনেক স্বনামধন্য জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান লাইফটাইম গ্যারান্টি ও ফ্রি সার্ভিসিং কার্ড দেয়, যা গহনা রক্ষণাবেক্ষণে সাহায্য করে।
এই কাগজপত্রগুলো বিক্রির সময় প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
১২. সোনা কেনার সময় সাধারণ কোন প্রতারণাগুলো থেকে সতর্ক থাকা উচিত?
সতর্ক ক্রেতা হতে চাইলে কিছু বিষয়ে সাবধান থাকুন:
- নিম্নমানের সোনা: ২২ ক্যারেট বলে ১৮ ক্যারেট বা সনাতন সোনা ধরিয়ে দিতে পারে। হলমার্ক চিহ্ন ও সার্টিফিকেট ছাড়া সোনা কিনবেন না।
- ওজনে কারচুপি: সঠিক ডিজিটাল দাঁড়িপাল্লায় ওজন মেপে নিন। ১ ভরি মানে ১১.৬৬৪ গ্রাম, এটি মনে রাখুন।
- পাথরের ওজন: পাথরের গহনা কেনার সময় নিশ্চিত হোন যে পাথরের ওজন বাদ দিয়ে শুধু সোনার ওজন হিসাব করা হচ্ছে।
- ভুয়া হলমার্ক: শুধু হলমার্ক আছে বললেই হবে না, বিশ্বস্ত হলমার্কিং সেন্টারের সিল বা চিহ্ন আছে কিনা যাচাই করুন।
১৩. সারা বাংলাদেশে কি সোনার দাম একই থাকে?
হ্যাঁ, সাধারণত বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (BAJUS) প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট মূল্যের তালিকা প্রকাশ করে, যা সারা দেশে কার্যকর থাকে। এই দাম আন্তর্জাতিক বাজার, ডলারের হার এবং স্থানীয় শুল্কের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।
তবে গহনার “মজুরি” বা বানানোর খরচ দোকান এবং শহরের ওপর কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।
১৪. ডলারের বিনিময় হার কীভাবে সোনার দামকে প্রভাবিত করে?
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সোনার দামের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সোনা বা কাঁচামাল আমদানি করতে হয় এবং পেমেন্ট ডলারে করতে হয়, তাই যখন টাকার বিপরীতে ডলারের মান বাড়ে (টাকার অবমূল্যায়ন হয়), তখন আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এই বাড়তি খরচ স্থানীয় বাজারে সোনার দাম বাড়িয়ে দেয়।
১৫. সোনা কেনার সেরা সময় কখন?
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সোনার দাম প্রায়শই ওঠানামা করে।
- বাজার পর্যবেক্ষণ: প্রতিদিনের বাজারদর অনুসরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ। বিশ্ববাজারে যখন সুদের হার বাড়ে, তখন সাধারণত সোনার দাম কিছুটা কমে।
- উৎসবের সময়: ভারতে বা বাংলাদেশে দিওয়ালি বা বিয়ের মৌসুমের আগে চাহিদা বাড়ায় দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ: যেহেতু দীর্ঘমেয়াদে সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় থাকে, তাই ভালো দামে কেনার জন্য খুব বেশি অপেক্ষা না করে যখনই প্রয়োজন বা সুযোগ আসে, অল্প অল্প করে কেনা যেতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পরিসংখ্যান (Key Takeaways)
- রেকর্ড মূল্য: ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ২২ ক্যারেট সোনার দাম ২ লাখ ১০ হাজার টাকা প্রতি ভরি অতিক্রম করেছে।
- হলমার্ক আবশ্যক: BAJUS-এর নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী, হলমার্ক বাধ্যতামূলক।
- বিনিয়োগের উপায়: ফিজিক্যাল গোল্ড বার (কম মজুরি) বা ডিজিটাল গোল্ড অ্যাপ (নিরাপদ স্টোরেজ) বিনিয়োগের সেরা মাধ্যম।
- কাগজপত্র: ক্যাশ মেমো ও সার্টিফিকেট ছাড়া সোনা কিনবেন না বা বিক্রি করবেন না।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১ ভরি ২৪ ক্যারেট সোনার দাম কত?
২৪ ক্যারেট সোনা সাধারণত বার আকারে পাওয়া যায়, গহনা হয় না। ডিসেম্বর ২০২৫-এর বাজারদর অনুযায়ী, ১ ভরি ২৪ ক্যারেট সোনার দাম প্রায় ২,১৬,০০০+ টাকা হতে পারে (বাজারের ওপর নির্ভরশীল)।
পুরোনো সোনা বিক্রি করলে কত টাকা ফেরত পাব?
পুরোনো হলমার্কবিহীন বা সনাতন সোনা বিক্রি করলে সাধারণত বাজার মূল্যের ওপর ২০% পর্যন্ত কেটে রাখা হতে পারে। হলমার্ক করা সোনা হলে এই কাটার পরিমাণ কম হতে পারে। সঠিক হারের জন্য কেনার সময় জুয়েলারি দোকানের নিয়ম জেনে নিন।
সোনা কি ব্যাংক লকারে রাখা নিরাপদ?
হ্যাঁ, সোনা সংরক্ষণের জন্য ব্যাংক লকার সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। যদিও এর জন্য বার্ষিক একটি চার্জ দিতে হয়, তবে চুরি বা হারানোর ঝুঁকি থাকে না।
২৪ ক্যারেট ও ২২ ক্যারেট সোনার মধ্যে পার্থক্য কী?
২৪ ক্যারেট সোনা হলো ৯৯.৯% খাঁটি (বিশুদ্ধতম রূপ), যা খুব নরম। ২২ ক্যারেট সোনা হলো ৯১.৬% খাঁটি, যা গহনা তৈরির জন্য যথেষ্ট শক্ত।
সোনা কেনার উপর কি কোনো ট্যাক্স বা ভ্যাট দিতে হয়?
হ্যাঁ, গহনা কেনার সময় সরকার নির্ধারিত ৫% ভ্যাট এবং ন্যূনতম ৬% মজুরি (making charge) ক্রেতাকে পরিশোধ করতে হয়।
উপসংহার
সোনা কেনা শুধুমাত্র একটি আর্থিক লেনদেন নয়, এটি একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ এবং আস্থার প্রতীক। বর্তমান বাজারের অস্থিরতায় একজন সচেতন ক্রেতা হিসেবে সঠিক তথ্য জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরি। হলমার্কযুক্ত সোনা কেনা, সঠিক কাগজপত্র রাখা এবং মজুরির বিষয়ে সচেতন থাকলে আপনি নিশ্চিতভাবেই লাভবান হবেন।
এই গাইডলাইন অনুসরণ করে আপনি সোনা কেনার সময় আত্মবিশ্বাসী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং আপনার কষ্টার্জিত অর্থ সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।

